Ads

গবেষণার পোস্টমর্টেম ও তারুণ্য



বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই গবেষণার আদ্যপান্ত সম্পর্কে জানতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় কিংবা চতুর্থ বর্ষে উঠে। তবুও খুব উৎসাহিত হয়ে কাজ করার লক্ষ্যে অনেকেই স্থির হতে পারেন না। আসলে গবেষণা এমন একটি বিষয়, যার মাধ্যমে আপনি সদূরে চিন্তা করার পথ খুঁজে পাবেন। যেহেতু হুট করে একদিনেই গবেষক হয়ে ওঠা যায় না, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই গবেষণায় ধ্যান স্থাপন করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যারা গবেষণা করেছেন, গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ সহ বিদেশে পড়ালেখার সুযোগ তাদের জন্য অনেকাংশেই এগিয়ে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফলের পাশাপাশি বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র, প্রবন্ধ, সম্মেলনপত্র আপনাকে নিঃসন্দেহে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখবে। পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের ক্ষেত্রে প্রকাশিত গবেষণাপত্র কে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে।
গবেষণার শিক্ষা একটি শিক্ষার্থীকে তার ভবিষ্যৎ নকশা তৈরিতে অনুপ্রাণিত করবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই আপনি সামনে কি নিয়ে গবেষণা করতে চান, তার একটি স্বচ্ছ পরিকল্পনা নেয়া উচিত। যাতে করে হাতে অনেকটা সময় নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করা যায়। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষণা সহায়ক, পিএচডি অধিকারী ব্যাক্তিদের পরামর্শ নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করা উচিত। গবেষণা বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার ও সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমেও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাতে পারে।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, গবেষণার শুরুতে কী করব? বা কোন কাজটি বেশি করতে হয়? উত্তর হচ্ছে, পড়ুন, পড়ুন এবং পড়ুন। আপনাকে প্রচুর পরিমাণে গবেষণাপত্র পড়তে হবে। আপনার গবেষণার বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত যত কাজ হয়েছে তার একটা পরিষ্কার ধারণা আপনাকে মাথায় গেঁথে নিতে হবে গবেষণাপত্র পড়ার মাধ্যমে। আপনি ভালো জার্নালের গবেষণাপত্র পড়ার মধ্যদিয়ে কিভাবে গবেষণাপত্র লিখতে হয়, তা খুব সহজেই শিখতে পারবেন। সুতরাং, গবেষণাপত্র পড়ার কোনো বিকল্প নেই।

গবেষণা পত্র তৈরির ক্ষেত্রে অনেকগুলি বিষয় লক্ষ্য করা বাঞ্ছনীয়। এর মধ্যে প্রথমেই থাকছে পত্রের ধরন। বিভিন্ন জার্নালে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পত্র প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখিত সম্মেলন পত্র, পরিপূর্ণ গবেষণাপত্র এবং সারাংশ পত্র যেটাকে ইংরেজিতে Abstract Paper বলা হয়। আপনাকে প্রথমেই আপনার বিষয়টি নির্ধারন করতে হবে, তারপর আপনি কোন ফরমেটে লিখতে চাচ্ছেন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, আপনি যদি সারাংশ পত্র দিয়ে শুরু করেন।
গবেষণা নিয়ে তিন ক আমি ইতিমধ্যেই আলোচনা করলাম। কখন, কেন এবং কিভাবে শুরু করব। গবেষণা শুরুর প্রথম ধাপ হচ্ছে আপনাকে অনবরত গবেষণাপত্র বা পেপার পড়তে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে পড়ব বা বিশ্লেষণের ধরনটা কেমন হওয়া উচিত? গবেষণার পোস্টমর্টেমে আমি এই বিষয়গুলিই সহজভাবে উপস্থাপন এবং বিশ্লেষণ করব।
গবেষণার বিষয় নির্ধারণঃ
প্রথমত আপনাকে আপনি কি নিয়ে গবেষণা করতে চান, তার একটি সুস্পষ্ট ধারণা নিতে হবে এবং নির্ধারণ করতে হবে। গবেষণার বিষয় নির্ধারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অনেকের প্রায় ৩ থেকে ৪ মাস কেটে যায় বিষয় নির্ধারণ করতে। আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছের জায়গা, দক্ষতা, পারিপার্শ্বিক উপযুক্ত পরিবেশ সব মিলিয়ে আপনাকে একটি পরিষ্কার সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে যে আপনি কি বিষয়ে গবেষণা করতে চান।
গবেষণাপত্র অনুসন্ধানঃ
আমি ধরে নিচ্ছি আপনি বেশ ঘাটাঘাটি করে আপনার গবেষণার বিষয় নির্ধারণ করতে পেরেছেন। এখন আপনাকে গবেষণা পত্র পড়া শুরু করতে হবে তার ই সূত্র ধরে আপনাকে পেপার খোঁজা শুরু করতে হবে। সাধারণত “Google Scholar” এ সকল ধরনের পেপার খুঁজে পাওয়া যায়। তাছাড়াও পছন্দের নির্ধারিত প্রকাশনা (Publications) থেকে পেপার খুঁজে বের করে এনেও পড়া যায়। IEEE, Springer, Elsevier কিছু ভালো প্রকাশনার উদাহরণ। এবার কথা হচ্ছে পেপার খোঁজার এর ব্যপারে। এটি প্রয়োজনীয়। আপনি ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে পেপার খুঁজতে পারেন। তাহলে একটি বিষয়ের উপর অনেক ধরনের পত্র আপনি খুঁজে পাবেন। উদাহরণ দিয়ে বলছি। ধরুন আপনি “চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রযুক্তি” নিয়ে গবেষণা করতে চাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে আপনি বিভিন্ন “Keyword” ব্যবহার করে খুঁজতে পারেন। যেমন- “Technology in Medical Science”, “AI in Medical Science”, “Medical Science Engineering”, “Automation in Medical Science”. এতে হবে কি, আপনি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি তে গবেষণা পত্র খুঁজে পেতে পারবেন যা আপনাকে Literature Review তৈরি তে ব্যাপক সহায়তা করবে। আশা করি বুঝাতে পেরেছি।
গবেষণা পত্র সংরক্ষণঃ
প্রথমত আপনাকে একটি পেপার পছন্দ করতে হবে পেপার টির Title দেখে। আপনি বিবেচনা করবেন যে এই টাইটেলের পেপার আপনার সম্পৃক্ত গবেষণার বিষয়ের সাথে যাচ্ছে কিনা। যদি যায়, তাহলে আপনি পেপার টির ভেতরে প্রবেশ করবেন। এরপর যেটি রয়েছে সেটি হচ্ছে Abstract. একটি পেপারের Abstract পড়েই সম্পূর্ণ পেপারটির ভাব বুঝতে পারা যায়। সহজ করে বলতে গেলে একটি গবেষণা পত্রের সারাংশ Abstract এ তুলে ধরা হয়। তো Abstract পড়েই আপনি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হতে পারবেন যে এই পেপারটা আপনি গ্রহন করছেন, কি করছেন না। এবার খুব প্রয়োজনীয় একটি কথা বলব। সেটি হচ্ছে Reference. আপনি যখন একটি গবেষণা পত্র ডাউনলোড করে পড়বেন এবং সেখান থেকে তথ্য গ্রহণ করবেন, তখন অবশ্যই আপনাকে Reference উল্লেখ করে দিতে হবে। তাই একটি পেপার পড়ার সময় Reference সংগ্রহ করে রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে চাই চিত্রে দেখানো  এ ক্লিক করে APA (American Psychological Association) style format এর reference আমরা সংগ্রহ করে রাখব।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কিভাবে সংরক্ষণ করে রাখব? আমি যেটা করে থাকি একটি ওয়ার্ড ফাইলে তিন কলাম বিশিষ্ট একটি টেবিল তৈরি করি। প্রথম কলামে Title, দ্বিতীয় কলামে Abstract এবং তৃতীয় কলামে APA References লিখে সংরক্ষণ করি। এতে করে খুব সহজে আপনি আপনার পেপার বাছাই করতে পারবেন। একটি গবেষণার বিষয়ে আপনাকে সর্বনিম্ন ৩০ টি পেপারের তথ্য এভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। তারপর আপনি সাজিয়ে বাছাই করে মূল গবেষণা পত্রে প্রবেশ করবেন।
মূল গবেষণা পত্র যেভাবে পর্যালোচনা করবেনঃ
আপনি যেই পেপার গুলো পর্যালোচনা করতে চাচ্ছেন, ইতোমধ্যেই তার Title এবং  Abstract পড়ে ফেলেছেন। এখন আমরা পেপারের বডি নিয়ে আলোচনা করব। একটি আদর্শ পেপারের বডি সাধারণত ৫ টি ভাগে ভাগ হয়ে থাকে।
Introduction:
১) এখানে প্রথমত আপনার গবেষণার বিষয়ের একটি সাধারণ বিশ্লেষণ থাকে।
২) আপনার প্রস্তাবিত সমাধানের আগে, বর্তমানে কি অবস্থায় বিষয়টি রয়েছে তার একটি ধারণা থাকে।
৩) প্রস্তাবিত সমাধানের একটি আনুমানিক ফলাফলের চিত্র তুলে ধরা হয়।
৪) সবশেষে কিভাবে গবেষণাপত্র টি সাজানো হয়েছে তা তুলে ধরা হয়।

Methodology:

Methodology কে আমরা গবেষোণা পত্রের ব্রেইন বলে আক্ষায়িত করতে পারি। এখানে মূলত সমস্যা এবং সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে। গবেষকরা যেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে থাকেন, সেই বিষয় কিভাবে সমাধান করা হবে তার একটি পরিষ্কার ধারণা দেয়া হয়ে থাকে। সহজ করে বলতে গেলে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে টেবিল, আইডিয়া সহজ ভাবে উপস্থাপন করতে ছবি এবং গ্রাফ ব্যবহার করে গবেষকের প্রস্তাবিত সমাধান তুলে ধরা হয়। আপনি যদি কোনো সমীকরন, মডেল বা কোনো সিস্টেম তৈরি করে থাকেন, সেটির বিস্তারিত আলোচনা Methodology এর মধ্যেই হয়ে থাকে।
Literature Review:
এটি সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয়। গবেষকরা যখন গবেষণার বিষয়বস্তুর সাপেক্ষে অনেকগুলো পত্র পড়বেন, তখন তাদের একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে হয়।  পঠিত পত্রগুলো থেকে অর্জিত জ্ঞান তারা তাদের পত্রের সাথে সংযুক্ত করে দিয়ে থাকেন। এতে করে কোথায় কি হচ্ছে, তাদের কাজ কতটা ফলপ্রসূ, কতটা অনন্য তার একটি শক্ত উপস্থাপন তুলে ধরতে সক্ষম হন।
Result / Discussion:
রেজাল্টে প্রস্তাবিত সমাধানের ফলাফল তুলে ধরা হয়। সংক্ষিপ্ত এবং নিদৃষ্ট করে ফলাফল তুলে ধরেন।  যার মাধ্যমে একজন গবেষক প্রমাণ করেন তার সমাধান একটি অনন্য গুরুত্ব বহন করে।
গ্রাফের মাধ্যমে গবেষকরা সুন্দর করে Result Analysis করে থাকেন।

Conclusion & References:
একটি গবেষণা পত্রের শেষ ভাগে সাধারণত এই গবেষণা থেকে কি শিক্ষা লাভ করা হলো এবং কতটুকু অর্জন করা হলো তা তুলে ধরে হয়। প্রতিটি গবেষণা পত্রের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে সেই সীমাবদ্ধতা গুলো এই অংশে তুলে ধরা হয় এবং এই বিষয় নিয়ে আরো গবেষণা করার পথ দেখিয়ে দেয়া হয়।
Reference নিয়ে আমি আগেই কথা বলেছিলাম। সেই Reference গুলিই এই অংশে দেয়া হয়ে থেকে।

গবেষণা নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা “গবেষোণার পোস্টমর্টেম” এখানেই আপাতত শেষ। একজন ক্ষুদ্র গবেষক হিসেবে প্রতিনিয়ত যা শিখছি তা তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে হৃদয়। বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের আহবানের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করতে ইচ্ছে করে। আমি সাধারণত IEEE Format এর গবেষণা পত্রের আলোকে পর্যালোচনা করলাম। এছাড়াও একটি গবেষণা পত্রে আরো বেশ কিছু ধরনের content  থাকতে পারে। যেগুলো নিয়ে ভবিষ্যৎ এ আলোচনা করা যাবে।

আমাদের দেশে বর্তমানে গবেষণা নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজ নিজ উদ্যোগে গবেষণাপত্র প্রকাশ করে যাচ্ছে। কিন্তু তরুণ গবেষকের উদ্দীপনা এখনো তেমন ভাবে লক্ষ্যনীয় হয়ে উঠছে না। গবেষণা শুধুমাত্র নিজের জন্য নয় দেশের জন্য, সমাজের জন্য। একেকটি গবেষণা নতুন কিছুর সৃষ্টির লক্ষ্যে এগোতে থাকে। তাই আমাদের তরুণ গবেষকদের জায়গা করে দেয়া খুবই প্রয়োজন। যারা গবেষণা করছেন তাদের উচিত সুন্দর করে গবেষণার মর্যাদা তুলে ধরা এবং সহজভাবে উপস্থাপন করা।
পরিশেষে বলতে চাই, আমি যার কাছ থেকে শিখছি তিনি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং বড় ভাই “ওমর শরীফ”। তিনি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসেবে রয়েছেন। অনেকেই মাঝপথে হাল ছেড়ে দেন। ধৈর্য্যশক্তি রেখে কাজ চালিয়ে যাওয়াই একজন সফল গবেষকের লক্ষ্য। প্রয়োজনে কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজে ফেরা যাতে পারে। কাজকে ছোট ছোট করে ভাগ করে নেয়া উচিত এবং অবশ্যই প্রতিটির জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়া উচিত। মানসিকভাবে দৃঢ় প্রত্যয়ী থাকতে হবে। নিজেকে উজ্জীবিত রাখতে হবে এবং নিজের কাজকে ভালোবাসতে হবে। তাহলেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।





No comments

Theme images by Aguru. Powered by Blogger.