Ads

চলুন ছাদে যাই



সাড়ে এগারোটায় এলার্ম বেজে উঠেছিলো

নিতুর
বাসা আমাদের বিল্ডিং এর ৬য় তলাতে। প্রায়ই আসা যাওয়া হয় দুই পরিবারের। আজকে নিতুর সাথে দ্বিতীয় বারের মতন ছাদে যাবো। সন্ধ্যায় কথা হয়েছে। বলেছে সাড়ে এগারোটায় ছাদে নিয়ে যাবে। নিতু খুব ভিতু প্রকৃতির মেয়ে। ভিতু প্রকৃতির মেয়েরা অবশ্য দেখতে খুব মায়াবতী হয়। তবে দুর্বল হৃদয় নিয়ে ডাক্তারি কিভাবে করে কে জানে! আমি সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছি, কখন সাড়ে এগারোটা বাজবে। নিতু ডাক্তার। সিলেটে থাকছে। পাহাড় নিতুর খুব পছন্দ। তাই হয়ত সিলেটেই থেকে যাওয়া। আজ সকালেই ঢাকা ফিরল। আমি তো অন্ধ মানুষ। চোখে দেখতে পাই না। না হলে হয়ত আমিও ৯ টা-৫ টা অফিস করতাম। ঘরে বসে গল্প, কবিতা লেখা আর সংবাদ শুনা ছাড়া আর কিছুই করার নাই। তবে নিতু বলেছে আমার চোখ ভালো হবে। আমি আবার দেখতে পাবো। আমি যখন নিতুকে প্রথম দেখেছিলাম তখন বেশ সুন্দর ছিলো নিতু। এখনো হয়ত তেমনই আছে কিংবা আরো বেশি সুন্দর। নিতুর সাথে প্রথম যখন ছাদে গিয়েছিলাম তখন আমার চোখ ভালো ছিলো। দু চোখ ভরে ভোরের আকাশ দেখেছিলাম। দেখেছিলাম নিতুর মুগ্ধ করা চাহনি। দখিনা বাতাসে খোলা চুলের ঢেউ। আজ দ্বিতীয় দিন। সময়ের পরিবর্তনে অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। আমি চোখে দেখতে পাই না। নিতুর বিয়ের কথা চলছে। কতটা দূরত্ব আমাদের মাঝে। অথচ সেদিন ছিলো কেবল ১ মিটারের দূরত্ব। তবুও আমি অপেক্ষা করছি ঘড়িতে কখন সাড়ে এগারোটা বাজবে। আমার ফোনে এলার্ম দেয়া আছে। প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে কত সহজ করে দিয়েছে। চোখে না দেখেও এলার্ম সেট করা যায়।

এলার্ম বাজার আগেই নিতু বাসায় আসলো

-কী নিতু সাহেব, এতদিন পর আপনার ডাক্তারি শেষ হলো?
-কেমন আছেন আপনি? চলুন ছাদে যাই।

নিতু আমার হাত ধরে ছাদে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ গতবারেই বলেছিলাম চোখ বন্ধ করে থাকলে কিন্তু আমাকে হাত ধরে হাঁটাতে হবে। বেশ রেগেছিলো তখন। সময় বদলে দিয়েছে পরিস্থিতি। “তাই না নিতু?” নিতু কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আমার পাশে। রাতের ঢাকা দেখতে খুব সুন্দর। আমি বেশ কয়েকদিন ধরে দেখতে পাচ্ছি না। আজ শুধু অনুভব করছি।

-আপনার বিয়ে কী ঠিক হয়ে গিয়েছে?
-না। কথা চলছে। দু মাসের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
-আপনি কি বিয়েতে রাজি না?
-রাজি হব না কেন?

আমি জানি নিতু রাজি না। নিতু স্বাধীনতা চেয়েছিলো। কিন্তু বদলাতে পারে নি নিতু, তাই নিজেকে বদলে নেয়ার চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছে।

-আপনার কী মন খারাপ?
-না, অনেকদিন পর ছাদে এলাম তো তাই বাতাস নিচ্ছি প্রাণ ভরে।
-আপনার বোনের সাথেও তো আসতে পারেন?
-ইচ্ছে করে না।
-আপনার চোখ ঠিক হয়ে যাবে।
-হ্যাঁ জানি তো। আপনাকে দেখতে পাচ্ছিনা, খুশি হচ্ছেন নিশ্চই? আপনি তো তা ই চেয়েছিলেন। আপনাকে জেন না দেখি।
-আপনার তাই মনে হচ্ছে?
-হ্যাঁ। তাই মনে হচ্ছে।

ভালোবাসার অপরুপ সৌন্দর্যের জায়গাটা হচ্ছে মন পরতে পারা। নিতু কাঁদছে আমি জানি। তবুও বলছে না। বলবেও না। আমিও কাঁদলে জানবে না নিতু। কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারবে। ভালোবাসলে কাঁদতে হয়।

-আজ কী চাঁদ আছে?
-হ্যাঁ আছে।
-আপনার মতন সুন্দর চাঁদ?
-হ্যাঁ আমার মতন সুন্দর চাঁদ।
-সমুদ্র দেখতে যাবেন?
-চলেন যাই।
-কবে যাবেন?
-কালই রওনা হওয়া যায়।
-আপনার ডাক্তারি?
-বন্ধ থাকবে কিছুদিন।
-কাল না, আমরা পরশু যাই। কাল আমার জন্মদিন।
-ঠিক আছে পরশু যাবো।
-নিতু সাহেব?
-বলুন।

এরপর আমি আর বলতে পারি না। নিতুও ফের কিছু জিজ্ঞেস করে না। কার্বন-ডাই-অক্সিডে সিক্ত নগরী ঢাকাকে খুব অচেনা লাগে রাতের বেলায়। সোডিয়াম আলোতে প্রাণ ফিরে পাওয়ার চেষ্ঠা করে এই অসুস্থ নগরী। আমি আর নিতু পাশাপাশি দাড়িয়ে আছি। কেউ কিছু বলছি না। আমি জানি সমুদ্র দেখতে গিয়েও কিছু বলতে পারবো না। নিতুও কিছু বলবে না। শুধু চুপচাপ চেয়ে থাকবে, শুনে যাবে, অনুভব করে যাবে।

-রাত ত অনেক হলো, চলুন যাওয়া যাক।
-চলুন যাই।

নিতু আবার আমার হাত ধরিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে। এবার আমিও শক্ত করে ধরে আছি নিতুর হাত। যতটা শক্ত করে ধরলে বুঝাতে পারা যায় “আমাকে ছেড়ে যেও না”। কিন্তু নিতু কি বুঝতে পারে হাতের ভাষা? মেডিকেল কলেজে কি হাতের ভাষা বুঝতে পারা শেখানো হয় না? নিতু কি স্বপ্ন দেখে না? কান্নায় আর্তনাদ করে ওঠে না ওর চোখ? তবুও কেন এত নিরবতা? কেন এত অস্পষ্টতা? প্রকৃতি ভালো জানে। প্রকৃতি মানুষকে করেছে বাধ্য। স্বাধীনতাকে কেড়ে নিচ্ছে নিমিষেই। তবুও আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। কল্পনায় নিজেকে রাঙাতে ভালোবাসি। অপেক্ষা করে মুগ্ধতাকে কাছে পেতে ভালোবাসি। নিতুকে সমুদ্রের পারে জ্যোৎস্না দেখাতে ভালোবাসি।

-মিটি মিটি হাসছেন কেন?
-আপনাকে নিয়ে সমুদ্র দেখতে যাব তাই।
-এতে হাসার কি আছে?
- আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?
-করুন।
-আপনি হাসলে কি এখনো টোল পড়ে?
-জানি না। চুপ করেন।
-ঠিক আছে। আমার মনে হয় ‘পড়ে’।
-পড়লে ভালো। আপনাকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় যাচ্ছি।
-সমুদ্রে কি আমি আর আপনি দুজন যাবো?
-তো কি ভুত সাথে করে নিয়ে যাবেন?
-নিলে দোষ কথায়?
-আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।
-ঠিক আছে যাওয়া লাগবে না। আমাকে বাসায় নামিয়ে দিন।
-আপনি এত অদ্ভুত কেন লেখক?
-সমুদ্রে গিয়ে বলব...



No comments

Theme images by Aguru. Powered by Blogger.